কক্সবাজার সমাচার ডেস্কঃ
গাজা পুনর্দখল এবং ফিলিস্তিনের কেবল একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা এই অঞ্চলের কৌশলগত বাস্তবতাকে বদলে দেবে না। এবং গাজা দখল করতে ৩ লাখ ৬০ হাজার সেনার প্রয়োজনও নেই। অথচ এই রেকর্ড সংখ্যক রিজার্ভ ফোর্সকে সম্পৃক্ত করেছে ইসরায়েল। মূলত গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের সরানোই এখানে উদ্দেশ্য। বৃহস্পতিবারের নির্দেশনা সেদিকেই ঈঙ্গিত করে।
হামাসের আকস্মিক হামলার পরপর ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এমন একটি প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন যা অনেকের মনোযোগ এড়িয়ে গেছে।
দক্ষিণ ইসরায়েলের শহরগুলোর মেয়রদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া ‘মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেবে’।
জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণেও নেতানিয়াহু একই কথা উল্লেখ করেন। সাথে যোগ করেন, আগামী দিনে আমরা শত্রুদের সাথে যা করব তা তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্মে প্রতিধ্বনিত হবে।
এই কথার অর্থ কি? আমরা জানি যে, বহুদিন ধরেই ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা করতে চায় ইসরায়েল। ২০১০ সালে প্রথম ব্যর্থ প্রচেষ্টার তিন বছর পর নেতানিয়াহু সিবিএসকে বলেছিলেন, বেশি দেরি হওয়া পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব না।
আমরাও জানি, তিনি হিজবুল্লাহ এবং হামাসকে নির্মূল করতে চান। যাদেরকে নেতানিয়াহু ইরানের ‘বিমানবাহী বাহক’ বলে মনে করেন।
শনিবার ফিলিস্তিনি যোদ্ধাদের হামলার পর থেকে তিনি এমন শব্দ ব্যবহার করছেন, যা টুইন টাওয়ারে হামলার পর মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশের প্রতিক্রিয়াকে প্রতিফলিত করে।
তাহলে কি অনেক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন পাওয়া নেতানিয়াহু বুশের মতোই গাজায় বড় কিছু ঘটানোর চেষ্টা করছেন? ইসরায়েলি বিরোধী দলীয় নেতা বেনি গ্যান্টসের কথাতেও একই সুর লক্ষ্য করা গেছে। তিনি বলেন, আমরা জিতব এবং এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও কৌশলগত বাস্তবতা বদলে দেব।
দ্বিতীয় নাকবা
গাজা পুনর্দখল এবং ফিলিস্তিনের কেবল একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে নিশ্চিহ্ন করা এই অঞ্চলের কৌশলগত বাস্তবতাকে বদলে দেবে না। এবং গাজা দখল করতে ৩ লাখ ৬০ হাজার সেনার প্রয়োজনও নেই। অথচ এই রেকর্ড সংখ্যক রিজার্ভ ফোর্সকে সম্পৃক্ত করেছে ইসরায়েল।
হামাসের সর্বোচ্চ ৬০ হাজার সশস্ত্র সদস্য আছে। অন্যান্যদের যোগ করেও তা ইসরায়েলের এক-তৃতীয়াংশের সমান হবে না।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কর্মকর্তাদের মুখে এর আগেও মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতির বদলে দেওয়ার গর্জন শুনা গেছে। তবে সেগুলো পরে ফাঁপা বুলি হিসেবে প্রমাণিত হয়েছে।
কিন্তু এবার যদি আসলেই বড় কিছুর পরিকল্পনা হয়? তাহলে পরিণতি কি হবে? এই অঞ্চল কি ধরনের ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
তাহলে প্রথম উত্তরই হবে ‘দ্বিতীয় নাকবা’। অর্থাৎ গাজার ২৩ লাখ মানুষের বড় অংশই বাস্তুহারা, ভূমিহারা হবে।
মঙ্গলবার বিদেশি সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে ইসরায়েলি ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল রিচার্ড হেচ বলেন, আমি ফিলিস্তিনিদের পরামর্শ দেব রাফাহ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মিশরে চলে যেতে। পরে তার কার্যালয় জানায়, সেই সীমান্ত বন্ধ আছে জেনেই এই মন্তব্য করেছেন তিনি।
মিশর হয়তো এক পর্যায়ে বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে জায়গা দিতে বাধ্য হবে। ১৯৪৮ এবং ১৯৬৭ সালের আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে যেমনটা ঘটেছে।
গাজা থেকে ১০ লাখ লোকের সিনাই-তে যাত্রা ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক সংকটে পড়া মিশেরের পরিস্থিতিকে আরো খারাপ করবে। অনেক মিশরীয় তাদের ভাগ্য পরিবর্তনে নৌপথে বিদেশে পাড়ি দিচ্ছেন।
‘মানুষরূপী জানোয়ার‘
জর্ডানে-যে ইসরায়েল সীমান্ত এখন পর্যন্ত সবচেয়ে শান্ত আছে- ফিলিস্তিনিদের শরণার্থী হিসেবে ঢোকার প্রভাবও হতে পারে নেতিবাচক।
দ্বিতীয় নাকবা অস্তিত্বের সংকটের মুখে ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য দুই আরব দেশকে চাপের মুখে ফেলবে। এতে নিজের ভূমিতে নিজেরে কর্তৃত্ব রক্ষার বিষয়টিও হুমকির মুখে ফেলবে। তারপরও ইসরায়েল হয়তো গাজা থেকে মানুষদের বিতাড়িত করার জোর চেষ্টা করতে পারে।
সোমবার ইসরায়েলি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়াভ গ্যালান্ত ফিলিস্তিনিদের ‘মানুষরূপী জানোয়ার’ হিসেবে আখ্যা দেন। একই দিনে নেসেট সদস্য রেভিটাল গটলিভ ইসরায়েলকে গাজায় পারমাণবিক বোমা ব্যবহার বিবেচনা করতে বলেন। সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট তিনি পোস্ট করেন, মধ্যপ্রাচ্যকে কাঁপিয়ে দেওয়ার মতো একটি বিস্ফোরণই পারে দেশের আত্মমর্যাদা, শক্তি ও নিরাপত্তা ফিরিয়ে দিতে।
আবার সাবেক জেনারেল গিওরা আইল্যান্ড বলেন, ইসরায়েলকে অবশ্যই গাজায় নজিরবিহীন মানবিক দুর্যোগ তৈরি করতে হবে। তিনি আরেকটি নাকবার হুমকি দেন।
আর সর্বশেষ শুক্রবার ইসরায়েলের উদ্দেশ্য নিয়ে বাকি সন্দেহও দূর হয়ে গেছে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনী ফিলিস্তিনিদের উত্তর গাজা থেকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সরে যেতে বলেন।
অর্থাৎ দ্বিতীয় নাকবা শুরু হয়ে গেছে।
রাতে রাতে হামলা
গাজায় প্রায় প্রতি রাতে বড় ধরনের হামলা চলছে। বোমবর্ষণের অনেকের পুরো পরিবার একসাথে মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তাদেরকে পুরো ডিস্ট্রিক্ট খালি করে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হচ্ছে। পুরো শহর ধুলোয় মিশিয়ে দেওয়ারও চেষ্টা চলছে।
এর আগেরবার গাজার ফিলিস্তিনিরা তুলনামূলক মধ্যবিত্তদের এলাকা রিমালে পালিয়ে যান। তখন এটিকে নিরাপদ স্থান বলেই ধরে নেওয়া হয়েছিল। কারণ ইসরায়েল সেখানে হামলা চালানোর কোনো কারণ ছিল না। কিন্তু এবার রিমালও ধ্বংস করা হয়েছে।
রাতের হামলাগুলো যে এলোমেলোভাবে হচ্ছে তেমনটা নয়, বরং পুরো পরিকল্পনা করেই বোমাবর্ষণ চলছে। তাদের লক্ষ্য হলো ২০ লাখ মানুষের খাদ্য, পানির উৎস ধ্বংস করা এবং তাদের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন করা। যাতে তারা পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।
এই ধরনের গণহত্যা থেকে গাজার কোনো জায়গাই নিরাপদ নয়। ১৪ টি হাসপাতালে বোমা হামলা হয়েছে, প্রায় ৫০০ এর বেশি শিশুর মৃত্যু হয়েছে। তারা এমন পর্যায়ের হামলা চালাচ্ছে যাতে দ্বিতীয় নাকবা বাস্তাবয়ন হয়।
হামাসের সর্বশেষ হামলার আগে এই নীতির দুই ধরনের প্রভাব হতে পারত; ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলে যাওয়া ফিলিস্তিনি এবং ইসরায়েলি ইহুদীদের মধ্যে গৃহযুদ্ধ কিংবা হিজবুল্লাহ ও ইরানের সম্পৃক্ততায় আঞ্চলিক যুদ্ধ।
বিষয়টি নেতানিয়াহুর মাথাতেও আছে। হামাসকে দমন মধ্যপ্রাচ্যকে বদলে দেব না। হিজবুল্লাহ এবং ইরান তাদের জন্য হুমকি হয়ে থাকবে।
আঞ্চলিক যুদ্ধ
এখনকার মতো আঞ্চলিক যুদ্ধ হওয়ার পরিস্থিতি এর আগে এতটা তৈরি হয়নি। ফিলিস্তিনিদের মানবেতর জীবন সব আরব দেশকে আবেগী করে তুলেছে।
ইসরায়েল বিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী ও প্রশিক্ষিত সশস্ত্র গোষ্ঠী হিজবুল্লাহ বন্দুক তাক করে আছে। দলটি তাদের সশস্ত্র সদস্যদের সমবেত করা শুরু করেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। লেবানন সীমান্ত থেকে কয়েকদিনে রকেট হামলাও হয়েছে।
যদি স্থল হামলা শুরু হয়েই যায়-যা খুব জলদি শুরু হতে পারে-তখন হয়তো হিজবুল্লাহ হামাসের প্রতিরোধের পর দুর্বল ইসরায়েলের মুখোমুখি হবে অন্যথা তারা হামাসের সঙ্গে একসাথে যুদ্ধ করবে। আসলে এমন অবস্থায় কেউই ইসরায়েলকে তাদের মর্জি মত কাজ করার সুযোগ দেবে না।
বৃহস্পতিবার ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেন আমির আব্দুল্লাহিন বলেন, ফিলিস্তিনিদেরও বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের প্রতিক্রিয়া অন্যদের থেকেও আসবে।
এখানে একটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ; যুক্তরাষ্ট্র আদৌ কি মধ্যপ্রাচ্যের আঞ্চলিক যুদ্ধে হোক তা চাইবে? যেখানে হুতির মতো ইরানের সাথে সম্পৃক্ত সব সশস্ত্র দল যুক্ত হবে। তাও এমন সময়ে, যখন ইউক্রেনের পাল্টা হামলা ব্যর্থ হয়েছে এবং শীতকাল আসন্ন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন যদি যুদ্ধজয়ের স্বাদ পেয়ে যায় এবং ইউরোপের যুদ্ধভীতি বাড়ে?
ভারসাম্যহীন মিত্রের সাথে যুক্ত হয়ে একটি অপরিকল্পিত মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধে জড়ানো কি যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কোনো মাইনে রাখবে? মনে হয় না। বাইডেন এখন নেতানিয়াহুকে একধরনের অন্ধ সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু সম্ভাব্য ক্ষতিকর ফলাফলের শঙ্কা নিয়ে মনে হয় না যুদ্ধ-খেলায় মেতে উঠবেন।
Leave a Reply