গাজা উপত্যকায় সর্বাত্মক স্থল আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এ আক্রমণে তাদের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জগুলোর একটি হচ্ছে গাজার ভূগর্ভস্থ হামাসের বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক। বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন যে স্থল আক্রমণে ইসরায়েলকে শত্রুর ভূখণ্ডে লড়াই করতে হবে।
ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা হামাসের সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কে আক্রমণ করছেন, তবে এ যুদ্ধ সহজ হবে না।
বিস্তৃত সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক এবং ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা ইসরায়েলের জন্য অন্যতম নিরাপত্তা চ্যালেঞ্জ হবে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন, তারা হামাসের সুড়ঙ্গের নেটওয়ার্কে আক্রমণ করছেন, তবে এ যুদ্ধ সহজ হবে না।
হামাসের সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক কতটা বিস্তৃত
২০২১ সালে ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী দাবি করেছিল যে হামাসের ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি সুড়ঙ্গ বা টানেল নেটওয়ার্ক তারা ধ্বংস করে দিয়েছে। হামাস নেতা ইয়াহিয়া সিনওয়ার তখন দাবি করেছিলেন গাজার সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক ৫০০ কিলোমিটার দীর্ঘ—এর মাত্র ৫ শতাংশ ধ্বংস হয়েছে।
বেসামরিক ভবন নিশানা করে হামলার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী সমালোচনার ঝড় উঠলে জবাবে ইসরায়েলি বাহিনী বারবার যুক্তি দিয়েছে যে হামাসের যোদ্ধারা বেসামরিক ভবনের নিচের সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করে আছেন। ২০০৭ সালে গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে শহরের মধ্যে এবং গাজা-ইসরায়েল সীমান্তজুড়ে সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ করেছে হামাস।
এই বিস্তৃত নেটওয়ার্কের কারণে ইসরায়েলি বাহিনী সুড়ঙ্গগুলোকে ‘গাজা মেট্রো’ বলে ডাকে। অতীতের বিভিন্ন ভিডিওতে দেখা গেছে, এই সুড়ঙ্গগুলোতে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুকানোর জন্য ভেতরে আলো ও পর্যাপ্ত জায়গার ব্যবস্থা করা হয়েছে। এসব সুড়ঙ্গের দেয়াল সিমেন্টের তৈরি। সুড়ঙ্গগুলোতে বিদ্যুৎ ও রেলট্র্যাকের ব্যবস্থাও থাকে।
৭ অক্টোবরের হামলায় টানেলের ভূমিকা
গত ৭ অক্টোবর হামাস বৃহৎ পরিসরে একযোগে রকেট, স্থল ও জল আক্রমণ করে। গাজার সঙ্গে ইসরায়েলের সীমান্তে বেড়া দেওয়া আছে। এছাড়া মানুষ চলাচল শনাক্ত করার জন্য সেন্সরও রয়েছে।
কিসিফিমের কাছে গাজা থেকে দক্ষিণ ইসরায়েলগামী একটি ফিলিস্তিনি সুড়ঙ্গের নির্গমন পথ, ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে। ছবি: এএফপি
কিন্তু হামাস ইসরায়েলে আকস্মিক হামলা শুরু করার আগে কোনো আগাম সতর্কবার্তা পাওয়া যায়নি। ধারণা করা হচ্ছে, সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে ইসরায়েলে প্রবেশের জন্য হামাস যোদ্ধারা কোনো আন্তঃসীমান্ত সুড়ঙ্গ ব্যবহার করে থাকতে পারেন।
এখন গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্ন রয়ে গেছে। গাজা ও ইসরায়েলের সীমান্তে দেওয়া বেড়ার উচ্চতা ৩০ ফুট, তার সঙ্গে ভূগর্ভস্থ কংক্রিটের দেয়ালও রয়েছে। তাহলে এই বেড়া ও ভূগর্ভস্থ দেয়ালের নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গ না খুঁড়ে সবার চোখ ফাঁকি দিয়ে কী করে ইসরায়েলে ঢুকলেন হামাস যোদ্ধারা?
গাজা সিটির সুড়ঙ্গগুলো অত্যাধুনিক, জটিল প্রকৃতির। বিপরীতে আন্তঃসীমান্ত সুড়ঙ্গগুলো অত জটিল নয়। রাইখম্যান ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ড. ড্যাফনে রিচমন্ড-বারাক বিবিসিকে বলেন, আন্তঃসীমান্ত সুড়ঙ্গগুলো মাত্র একবার ব্যবহারের জন্য, অর্থাৎ ইসরায়েলে আক্রমণ করার জন্য খোঁড়া হয়েছে।
অন্যদিকে গাজা সিটির সুড়ঙ্গগুলো দীর্ঘদিন ব্যবহারের জন্য টেকসই করে বানানো হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রিচমন্ড-বারাক। তিনি বলেন, হামাস নেতারা এসব সুড়ঙ্গে আত্মগোপন করে আছেন। তাদের কমান্ড-অ্যান্ড-কন্ট্রোল সেন্টার আছে। সেগুলো তারা পরিবহন ও যোগাযোগের জন্য ব্যবহার করেন।
গাজার সুড়ঙ্গের ইতিহাস
হামাস গাজা উপত্যকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার আগে এই সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্ক চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হতো। ২০০৫ সালে গাজা ইসরায়েলের নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হওয়ার পর—এবং ২০০৬ সালের নির্বাচনে হামাস জয়লাভের পর—ইসরায়েল ও মিশর গাজার সঙ্গে সীমান্তের ওপারে পণ্য ও মানুষের চলাচল সীমিত করতে শুরু করে।
ওই সময় মিসর সীমান্তে সুড়ঙ্গগুলো পণ্য, তেল ও অস্ত্র চোরাচালানের জন্য ব্যবহার করা হতো। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে চোরাচালানের জন্য সুড়ঙ্গগুলোর ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। কারণ ইসরায়েল তাদের ক্রসিং ব্যবহার করে বেশি পণ্য আমদানির সুযোগ দিতে আরম্ভ করে।
পরে মিশর গাজা সীমান্তের সুড়ঙ্গগুলো ধ্বংস করে দেয়। কিন্তু হামাস ইসরায়েলের দিকের সুড়ঙ্গগুলো আরও প্রসারিত করে। এগুলো ইসরায়েলের সঙ্গে লড়াইয়ে ব্যবহার করতে শুরু করে হামাস।
২০০৬ সালে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে আন্তঃসীমান্ত অভিযানে ইসরায়েলি সৈনিক গিলাদ শালিদকে বন্দি এবং তার দুই সহকর্মীকে হত্যা করা হয়। দুই বছর আটকে রাখার পর বন্দি বিনিময় চুক্তির আওতায় শালিদকে মুক্তি দেয় হামাস।
এর পরের বছরগুলোতে ইসরায়েল গাজা উপত্যকায় নির্মাণসামগ্রীর প্রবেশ সীমিত করে দেয়, যাতে হামাস সুড়ঙ্গ তৈরি করতে না পারে। ২০১৪ সালে ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রকাশিত একটি ছবিতে সীমান্তের ওপারে একাধিক সুড়ঙ্গ দেখানো হয়েছে।
স্থল আক্রমণে সুড়ঙ্গের ভূমিকা
স্থল আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে ইসরায়েল। এখন তাদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে হামাসের হাতে জিম্মি দেড় শতাধিক ইসরায়েলির নিরাপদ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করা। ইসরায়েলের একটি নিরাপত্তা সূত্র বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে জানিয়েছে যে জিম্মিদেরকে ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গে রাখা হতে পারে।
ওই সূত্র বলেছে, ‘অধিকাংশ লক্ষ্যবস্তু—মানুষ, সরঞ্জাম, রসদ—মাটির নিচে, এবং জিম্মিদের ভূগর্ভস্থ টানেলে রাখা সম্ভব। আমাদের উদ্দেশ্য হবে সবকিছু মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দেওয়া, যাতে ভূগর্ভস্থ বাঙ্কারে প্রবেশ যায়।’
ইসরায়েল বাঙ্কার বাস্টার বোমা ও মেরকাভা ট্যাঙ্কের ওপর নির্ভর করবে। তবে বুবি ট্র্যাপ ও হামাস যোদ্ধাদের মোকাবিলা করতে হবে তাদের। ভূগর্ভস্থ সুড়ঙ্গগুলো হামাস যোদ্ধাদের কাছে হাতের তালুর মতোই পরিচিত। আক্রমণ, আত্মগোপন ও পালানোর জন্য তারা এসব সুড়ঙ্গ ব্যবহার করতে পারবেন।
ড. রিচমন্ড-বারাক বিবিসিকে বলেন, সুড়ঙ্গ নেটওয়ার্কে বুবি-ট্র্যাপ পাতার জন্য যথেষ্ট সময় পেয়েছে হামাস। ‘সৈন্যদের টানেল নেটওয়ার্কে প্রবেশ করতে দেওয়ার পরপরই তারা পুরো সুড়ঙ্গ উড়িয়ে দিতে পারে,’ বলেন তিনি।
হামাসের পলিটব্যুরোর ডেপুটি চিফ সালেহ আল-আরৌরি আল জাজিরাকে বলেছেন, ইসরাইল আক্রমণ করার আগে হামাস আক্রমণ পরিকল্পনার চেয়েও ‘শক্তিশালী’ প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা তৈরি করেছে।
এদিকে গাজার ভবনগুলোতে ইসরায়েলের বিমান হামলায় উপত্যকায় দুই মিলিয়ন জনসংখ্যার মানবিক বিপর্যয়ে পড়বে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হামলার তীব্রতা কমানোর জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়তে হতে পারে তেল আবিবকে। গাজার সুড়ঙ্গগুলো ইসরায়েলের জন্য দীর্ঘ যুদ্ধ নিশ্চিত করতে পারে। কিন্তু দীর্ঘ যুদ্ধ চালিয়ে যাবার মতো সময় হয়তো ইসরায়েল পাবে না।
Leave a Reply