1. coxsbazarshomachar@gmail.com : admin :

আল্লাহ মেঘ দে পানি দে’ – যে কারণে ইসতিসকার নামাজ যুগে যুগে

  • পোস্টিং সময় : বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল, ২০২৪

দীর্ঘ বৈচিত্র্যময় এই লোকাচারের সঙ্গে  মুসলমান সমাজেও প্রচলিত আছে নামাজ-প্রার্থনার। তাপদাহে বৃষ্টির জন্য ইসলামের সূচনাকাল থেকেই আছে বিশেষ প্রার্থনা। অনাবৃষ্টি, খরায় মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন যা ইসতিসকারের নামাজ নামে পরিচিত। এই নামাজ মূলত বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। বাংলা অঞ্চলেও এ নামাজের প্রচলন বহুকাল ধরেই।

“আল্লাহ মেঘ দে পানি দে ছায়া দে রে তুই আল্লাহ মেঘ দে, আসমান হইল টুটা টুটা জমিন হইল ফাটা মেঘ রাজা ঘুমাইয়া রইছে মেঘ দিব তোর কেডা…”

শিল্পী আব্বাসউদ্দিনের গাওয়া এই লোকগানটি এখনো লোকমুখে ফেরে। বৃষ্টি চেয়ে বাংলা অঞ্চলের লোক যুগ যুগ ধরে এই গান গাইছে। গানটির রচয়িতা ও সুরকারের নাম অজানা। এই গান মনে করিয়ে দেয় বাংলা কৃষিপ্রধান ও নদীমাতৃক দেশ। সে কারণে প্রকৃতি নির্ভরতাও বেশি।

অতীতে এ নির্ভরতা ছিল আরো বেশি। তাই অনাবৃষ্টি ও দাবদাহ ফসল নষ্ট হওয়ার ভীতি তৈরি করত। খাল, বিল শুকিয়ে যাওয়ায় খাবার পানির সংকটও দেখা দিত। তাই বৃষ্টি চেয়ে নানান লোকাচার তৈরি হয় । এর মধ্যে আছে ব্যাঙের বিয়ে, তালতলার শিন্নি, শরীরে কাদা মাখানো, হুদুম দ্যাও বা মেঘ পূজা ইত্যাদি। তালতলার শিন্নিতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দুধ, চাল, গুড় সংগ্রহ করা হয়। তারপর সেগুলো নিয়ে গ্রামের সবচেয়ে উঁচু গাছের তলায় ( বেশিরভাগ ক্ষেত্রে হয়ে থাকে তালগাছ) হাঁড়ি চড়িয়ে শিন্নি রান্নার আয়োজন করা হয়।  গ্রামের সকলে জড়ো হয় সে শিন্নি খেতে, তারপর সবাই মিলে বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে।

কুলা নামানিও একটি প্রসিদ্ধ লোকাচার। এতে  একটি নতুন কুলা ধান, দূর্বাঘাস দিয়ে সাজানো হয়। তারপর গাঁয়ের কোনো কিশোর বা কিশোরীর মাথায় সে কুলা তুলে দেওয়া হয়। বহনকারীর পেছনে চলতে থাকে বালক-বালিকার এক বড় দল। তাদের মুখে মাখানো থাকে চুন-কালি, যাকে ধরা হয় মেঘের প্রতীক। দলটি বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল, ডাল, তেল, সবজি সংগ্রহ করে। তখন সেসব বাড়ির বড়রা দলটিকে ভিজিয়ে দেন, আর বৃষ্টি নামানোর জন্য গান ধরেন।

উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সমাজের বৃষ্টির দেবতা হলেন হুদুম দ্যাও। তাকে উৎসর্গ করে মেঘ পূজার আয়োজন করা হয়। মাঝ চৈত্র থেকে বৈশাখের প্রথমার্ধ পর্যন্ত এ পূজার সময়কাল।  এর জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ হলো ফিঙে পাখির বাসা, কলাগাছ, পান-সুপারি, পানিভর্তি ঘট ইত্যাদি। পুরুষরা এতে অংশ নিতে পারেন না। প্রায় সব লোকাচারেরই অনুষঙ্গ ছড়া বা গান। মেঘ পূজার এক পর্যায়ে যেমন অংশগ্রহণকারী নারীরা গেয়ে  ওঠেন,

কালা ম্যাগ, উতলা ম্যাগ, ম্যাগ সোদর ভাই, এক ঝাঁক পানি দ্যাও গাও ধুইবার চাই। 

এই সব লোকাচার এখন বিলুপ্ত প্রায়। ব্যাঙের বিয়ে এখনও দেশের কোথাও কোথাও প্রচলিত আছে। এ প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ ও লোকসংস্কৃতি গবেষক আফসান চৌধুরী বলছিলেন, “আমাদের গ্রামীণ অর্থনীতি এখন আর আগের মতো কৃষি নির্ভর নয়। প্রবাসী আয় কৃষি অর্থনীতির স্থান দখল করেছে। তাছাড়া সেচ ব্যবস্থার উন্নতি ঘটেছে, তাপ সহনীয় (হিট রেজিস্ট্যান্ট) বীজের প্রচলন ঘটেছে, তাই কৃষক আর ফসল নষ্ট হওয়ার ভয়ে ভীত নয়। এখন তাই লোকাচারও বিলুপ্ত হতে বসেছে। মানুষ এখন বরং গরমে কষ্ট পাওয়ার ভয়ে ভীত। ফলাফলে গ্রামেরও অনেক বাড়িতে এখন এসি দেখা যায়, প্রায় সব বাড়িতে ফ্রিজ আছে। এটা একটা মৌলিক পরিবর্তন।

” দীর্ঘ বৈচিত্র্যময় এই লোকচারের সঙ্গে  মুসলমান সমাজেও প্রচলিত আছে নামাজ-প্রার্থনার।  তাপদাহে বৃষ্টির জন্য ইসলামের সূচনাকাল থেকেই আছে বিশেষ প্রার্থনা। অনাবৃষ্টি, খরায় মুসলমানরা নামাজ আদায় করেন যা ইসতিসকারের নামাজ নামে পরিচিত। এই নামাজ মূলত বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা। বাংলা অঞ্চলেও এ নামাজের প্রচলন বহুকাল ধরেই।

মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেব ‘ফতোয়ায়ে আলমগীরি’তে এ নামাজ আদায়ের কারণ ও উপায়ের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন। মদিনায় মসজিদে নববীর কাছে আল গামামাহ নামে একটি মসজিদ আছে। ‘গামামাহ’ শব্দের অর্থ মেঘমালা। মসজিদ হওয়ার আগে স্থানটি ছিল উন্মুক্ত প্রান্তর। বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করে নবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) এখানে দু’রাকাত নামাজ আদায় করেছিলেন। সে স্মৃতি রক্ষার্থে ৯১ হিজরিতে খলিফা ওয়ালিদ বিন মালেক এখানে মসজিদ নির্মাণ করেন এবং মসজিদের নামকরণ হয় আল গামামাহ।

হযরত আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, একবার রাসুলুল্লাহ (সা.) এর যামানায় মানুষ দুর্ভিক্ষের শিকার হলো। ওই সময় একদিন জুমার দিনে রাসুলুল্লাহ (সা.) মিম্বরে উপবিষ্ট হয়ে লোকদের সামনে খুতবা দিচ্ছিলেন। এক বেদুঈন দাঁড়িয়ে বলল, ইয়া রাসুলুল্লাহ (সা.) ধনসম্পদ বরবাদ হয়ে গেল, সন্তান সন্ততি ক্ষুধায় কাতর হয়ে পড়েছে, (অনাবৃষ্টির ফলে) মালসম্পদ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে, জীবিকার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অতএব আল্লাহর কাছে দুআ করুন যেন তিনি আমাদের মেঘদান করেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) দুই হাত উঠিয়ে দুআ করলেন, হে আল্লাহ! আমাদের মেঘ দিন। ক্ষণিকের মধ্যে পেছন থেকে ঢালের ন্যায় একখণ্ড মেঘ উদিত হলো। একটু পর তা মাঝ আকাশে এলে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ল এবং বৃষ্টি শুরু হলো।

আব্বাদ ইবনে তামীম মাযেনী তার চাচার সূত্রে বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ইসতিসকার উদ্দেশে মাঠের দিকে বের হয়ে গেলেন । যখন তিনি দোয়া করার ইচ্ছা করলেন, কেবলামুখী হলেন এবং নিজের চাদর উল্টে দিলেন।

ইসতিসকারের নামাজ প্রসঙ্গে  ধানমন্ডির মসজিদ উত তাকওয়ার খতিব মুফতি সাইফুল ইসলাম বললেন, “এ নামাজের উল্লেখযোগ্য দিক হলো, সমবেতভাবে আদায় করা এবং কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত (তওবা বা এস্তেগফার) হওয়া। সমাজে যখন বিশৃংখলা দেখা দেয় বা সমাজ সামগ্রিকভাবে অপরাধপ্রবণ হয়ে ওঠে, তখন অনাবৃষ্টির মতো আজাব (শাস্তি) আসে। বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য যেমন গ্রিন হাউস গ্যাসকে দায়ী করা হচ্ছে– অনাবৃষ্টিরও অনেক কারণ খুঁজে পাওয়া যায়। এসব দৃশ্যমান কারণের সঙ্গে কিছু অন্তর্নিহিত কারণও রয়েছে। অনাবৃষ্টি মানুষের কৃতকর্মেরই ফল।”

মুফতি সাইফুল ইসলাম জানান, “গাছপালা বা সবুজ, বৃষ্টি, নদ-নদীর উপকারিতার প্রসঙ্গ আছে হযরত নূহ (আ.) এর উপদেশেও। তিনি তার কওমকে বলছেন, তোমরা যদি ক্ষমা চাও তবে তিনি (আল্লাহ) ক্ষমা করবেন, সেইসঙ্গে বৃষ্টি দান করবেন, নদ-নদীর ব্যবস্থা করবেন, সবুজের সমারোহ ঘটাবেন।”

বৃষ্টির গুরুত্ব হযরত মুসা (আ.) এর সময়ের একটি ঘটনা থেকেও জানা যায়। তার অনুসারীরা বৃষ্টির জন্য প্রার্থনা করতে এক স্থানে জড়ো হয়েছিলেন। তারা খুব কাতর হয়ে প্রার্থনা করতে থাকলেন, কিন্তু তাতে ফল মিলল না। শেষে জানা গেল,  উপস্থিত একজন অপরাধীর জন্য প্রার্থনা কবুল হচ্ছে না। তখন সে ব্যক্তি (অপরাধী) মনেপ্রাণে লজ্জিত হলেন এবং তার পরিচয় প্রকাশ না করার জন্য আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতে থাকলেন। তার প্রার্থনা কবুল হলে পরে বৃষ্টি হয়েছিল।

আফসান চৌধুরীর মতে, “মানুষ যখন বিপদে পড়ে, তখন ধর্মচর্চা বাড়ে। বাবার কাছে ১৯৩০ সালে ইসতিসকার নামাজ আদায়ের এক ঘটনা শুনেছি। নামাজ পড়ার সময়ই বৃষ্টি চলে আসে, আর মানুষ নামাজ ছেড়ে দিয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে থাকে। তখন আমার দাদা সবাইকে ডেকে বলেন, বৃষ্টির জন্য এতো হাপিত্যেশ আর এখন ভিজতে হবে বলে দৌড়াদৌড়ি! ওই কথায় ভুল বুঝতে পেরে আবার সবাই নামাজে শরীক হয়।”

১৯৫৫-৫৬ সালের এক ইসতিসকার নামাজের জামাতের কথাও মনে করতে পারলেন আফসান চৌধুরী। তিনি বলছিলেন, “দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সম্ভবত ১৯৭৫ বা ৭৬ সালেও ইসতিসকার নামাজ অনেক স্থানে পড়া হয়েছে।”

সাইফুল ইসলাম জানিয়েছেন, মাঝে কিছুকাল এ নামাজের প্রচলন বেশি ছিল না।  পরে ২০১৪, ২০১৬,  ২০২২, ২০২৩ সালে অনেক স্থানেই এ নামাজ পড়ার খবর পাওয়া গেছে। তবে কেবল প্রার্থনা দিয়ে অনাবৃষ্টির আজাব এড়ানো যাবে বলে মনে করেন না সাইফুল ইসলাম। বলছেন, “কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণ যদি উষ্ণায়নের কারণ হয়– তবে তার নিঃসরণ বন্ধ করা হলো এস্তেগফার। প্রার্থনা করব আবার গাছও কাটব– তা হবে না। প্রার্থনা করতে হবে, গাছ কাটাও বন্ধ করতে হবে, নদী ভরাট বন্ধ করতে হবে, পরের হক নষ্ট করা থেকে বিরত থাকতে হবে তবেই রেহাই পাওয়া যাবে শাস্তি থেকে।”

বৈশাখের প্রথম সপ্তাহ থেকেই প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে দেশ। নড়াইল, চুয়াডাঙ্গা, কুষ্টিয়া এবং ঢাকায়ও ইসতিসকার নামাজ আদায়ের খবর পাওয়া গেছে। এরমধ্যে চুয়াডাঙ্গায় টানা দেশের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।

মূল : সালেহ শফিক, সৌজন্যে – টিবিএস

সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়ুন
সর্বস্বত্ত্ব সংরক্ষিত © ২০২৩ কক্সবাজার সমাচার
Site Customized By NewsTech.Com
error: Content is protected !!