মোঃ নাজমুল হুদাঃ
বান্দরবান, রাঙামাটি ও খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলায় চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, তঞ্চঙ্গ্যা, চাক, ম্রো, খুমী, খেয়াংসহ ১১টি জাতিগোষ্ঠীর সবচেয়ে বড় সামাজিক উৎসব বিজু, সাংগ্রাইং, সাংলান, চাংক্রান,বৈসু, বিষু উদযাপনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে। তিন পার্বত্য জেলায় গ্রামে গ্রামে উৎসবের আমেজ সৃষ্টি হয়েছে।
বান্দরবানে সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন কমিটি গঠন করা হয়েছে, গ্রামে গ্রামে চলছে উৎসবের প্রস্তুটি।
তিন পার্বত্য জেলায় পাহাড়ীদের ১১টি জনগোষ্টীর মধ্যে চাকমা সম্প্রদায় হচ্ছে জনসংখ্যায় বেশী তাদের উৎসব বিজু শুরু হয় ১২এপ্রিল থেকে ১৪এপ্রিল পর্যন্ত। ১২ এপ্রিল ফুল বিজু এইদিনে সকালে নদীতে জল বুদ্ধ ও মা গঙ্গাকে ফুল, মোমবাতি দিয়ে পূজা করার মধ্যদিয়ে। তারা প্রার্থনা করে এবছর ভালোছিলাম সুখে শান্তিতে ছিলাম আগামী বছরও ভালো থাকার প্রত্যাশায় প্রার্থনা করে জলবুদ্ধ ও মা গঙ্গার কাছে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ও ১২এপ্রিল প্রথম দিন হারি বৈসু নদীতে মা গঙ্গাকে ফুল, মোমবাতি দিয়ে পুজা করে সুখে শান্তিতে থাকার প্রার্থনা করে পালন করে। তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায় ১২প্রিল নদীতে ফুল দিয়ে জলবুদ্ধ ও মা গঙ্গাকে ফুল দিয়ে পূজা করে বিষু উৎসব শুরু করে। সেদিন বাংলাদেশ তঞ্চঙ্গ্যা কল্যান সংস্থার পক্ষ থেকে রাতব্যাপী ঘিলা খেলা আয়োজন করা হয়।
বান্দরবানে মারমা সম্প্রদায়ের মুল অনুষ্টান শুরু হবে ১৩এপ্রিল থেকে সাংগ্রাইং র্যালী করার মধ্যে দিয়ে। কিন্তু মাস ব্যাপী মাহাঃ সাংগ্রাইং পোয়ে উৎসব শুরু হয়েছিল ১৬মার্চ ক্রিকেট টুর্নামেন্ট উদ্বোধনীর মধ্য দিয়ে। মারমা সম্প্রদায়ের মূল আকর্ষণ রি লংবোই ( মৈত্রী পানি বর্ষণ)। এটা ১৮এপ্রিলে শেষ হবে যেখানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক উপদেষ্টা সুপ্রদীপ চাকমা। মারমা ভাষায় রি লংবোই একে অপরকে পানি নিক্ষেপ করা হয়। এই খেলায় সচরাচর যুবক-যুবতি, তরুন-তরুণীরা দলবেধে অংশ নিয়ে থাকেন, এখানে প্রবাদ আছে এই রি লংবোই খেলা থেকে যুবক -যুবতীরা একেঅপরকে পছন্দ করে জীবন সঙ্গীকে খুঁজে নেয়।
এই উৎসবে চাকমাদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো সপ্তাব্যপী গ্রামে গ্রামে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন আর ১২এপ্রিল ফুল বিজুর দিনে ভোরে দলবেঁধে বিভিন্ন নদীতে জলবুদ্ধ ও গঙ্গাদেবীকে পূজা করা, ফুলের মালা দিয়ে ঘরের দরজায় সাজিয়ে তোলে । বান্দরবানের সাঙ্গু নদী,মাতামুহুরি , রাঙামাটির কাপ্তাই লেক ও কাচালং নদী, খাগড়াছড়ির মাইনী ও চেঙ্গী নদীতে ফুল দিয়ে জলবুদ্ধ ও গঙ্গাদেবীর পূজা করে উৎসবের সূচনা করা হয়।
১৩এপ্রিল চাকমাদের মুল বিজু সেদিন ঘরে ঘরে বিভিন্ন পিঠাপুলির আয়োজন করে মেহমানদেরকে পরিবেশন করা হয়। সবচেয়ে মজার খাবার হলো পাজন তরকারী যেখানে ৩০-৩৫ প্রকার বিভিন্ন সবজি মিশ্রণ করে রান্না করে অতিথিদের পরিবেশন করা হয়, সাথে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন প্রকার পিঠা তো থাকেই । চাকমারা বিশ্বাস করে বিজুর দিনে এই ধরনের পাজন ৭টি বাড়িতে খেলে রোগ-ব্যাধি কম হয় কিংবা রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ে।
১৪এপ্রিল গজ্যা-পজ্জ্যা এদিন নতুন বছর বৌদ্ধ ভিক্ষুদের বাড়িতে আমন্ত্রণ করে মঙ্গল সুত্রপাত শোনা হয়। এলাকার মুরুব্বী ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনকে বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে উত্তম খাবার পরিবেশন করা হয় এবং বয়স্ক নারী পুরুষদেরকে যুবক-যুবতীরা তাদের বাড়িতে গিয়ে গোসল করিয়ে মুরুব্বিদের কাছে আর্শীবাদ প্রার্থণা করে । চাকমারা বিশ্বাস করে বছরের প্রথমদিন মঙ্গলজনক কাজ করলে, উত্তম কাজ করলে সারাবছর সুখে শান্তিতে থাকা যায় ।
মারমাদের সাংগ্রাইং শুরু হয় ১৩এপ্রিল পাইংসোয়াইং, সেদিন বাড়ী ঘর ফুলদিয়ে সাজানো, বৌদ্ধ বিহারে পুজা অর্চনা করে। ১৪এপ্রিল বৌদ্ধ মুর্তিকে স্নান করানো হয়। তারপর শুরু হয় মৈত্রী পানি বর্ষণ খেলা।
বান্দরবানে সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন কমিটির সভাপতি চনু মং মারমা জানান । এবছর বান্দরবান রাজার মাঠে ১৬এপ্রিল থেকে আকর্ষণীয় রি লংবোই (মৈত্রী পানি বর্ষণ) খেলা শুরু হবে । সাংগ্রাইং উৎসব উপলক্ষে বান্দরবান সাংগ্রাইং উৎসব উদযাপন কমিটি মাসব্যাপী বিভিন্ন কর্মসুচী হাতে নিয়েছে। ইতি মধ্যে ১৬মার্চ থেকে ক্রিকেট টুর্নামেন্ট শুরু করেছে, ১২ এপ্রিল মিনি ম্যারাথন, ১৩ এপ্রিল সাংগ্রাইং র্যালী, ১৪ এপ্রিল বলি খেলা, পিঠা উৎসব, সর্বশেষ ১৮ এপ্রিল রিলোং বোই (মৈত্রী পানি বর্ষণ) উৎসবের মধ্যে দিয়ে জেলা শহরে অনুষ্টান শেষ হলেও বিভিন্ন উপজেলা,ইউনিয়ন ও গ্রাম পর্যায়ে ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই উৎসব চলবে বলে জানান তিনি।
ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের ১২এপ্রিল থেকে ১৪ এপ্রিল তিনদিন ব্যাপী বৈসু উৎসব উদযাপন করে থাকে। ১২এপ্রিল হারি বৈসু, ১৩ এপ্রিল বৈসুমা, ১৪এপ্রিল বিচিকাঠাল বলে। ত্রিপুরা সম্প্রদায়ের গড়াইয়া নৃত্য হচ্ছে উৎসবের মূল আকর্ষণ। যদিওবা এই গড়াইয়া নৃত্য দলবেঁধে মার্চ মাসের প্রথম থেকে শুরু হয়ে ১৪এপ্রিল শেষ হয়। অনুরুপ ভাবে তঞ্চঙ্গ্যা সম্প্রদায়ের বিষু, খেয়াং সম্প্রদায়ের সাংলান, ম্রো সম্প্রদায়ের চাংক্রান, চাক সম্প্রদায়ের সাংগ্রাইং, রাখাইনদের সাংগ্রাইং একেক সম্প্রদায় একেক নামে প্রতিবছর উদযাপন করে।
পুরো পার্বত্য চট্টগ্রাম প্রতিবছর মার্চ মাসের শেষ সময় থেকে মধ্যে এপ্রিল পর্যন্ত উৎসব মূখর থাকে বান্দরবান-রাঙ্গামাটি-খাগড়াছড়ি তিন পার্বত্য জেলা। ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরিধান করে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ, বাড়ি বাড়ি বিভিন্ন পিঠাসহ খাবারের আয়োজন এবং ঐতিহ্যবাহী খেলাধুলা, আনন্দ-উল্লাস উৎসব মুখর পরিবেশে উৎসবটি পার্বত্য চট্টগ্রামের ১১টি জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সামাজিক সম্প্রীতি, বন্ধনের ঐক্যের প্রতীক হিসেবে হাজার বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে।
পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ীদের ১১টি জনগোষ্ঠীর এই সর্ববৃহৎ সামাজিক উৎসব কবে কখন শুরু হয়েছে সুনির্দিষ্টভাবে কেউ বলতে না পারলেও সম্রাট আকবর কিংবা তারও আগে থেকে এই সবর্বৃহৎ সামাজিক উৎসব শুরু হয়েছে বলে মনে করা হয়।
ছবি ক্যাপশনঃ বান্দরবানের সাঙ্গু নদীতে জলবুদ্ধ ও মা গঙ্গাদেবীকে ফুলদিয়ে পূজার মধ্যদিয়ে চাকমাদের বিজু,তঞ্চঙ্গ্যাদের বিষু
Leave a Reply