মোঃ নাজমুল হুদা, বান্দরবানঃ পাহাড় মানেই প্রকৃতির রঙিন ক্যানভাস। সবুজের ঢেউ, ঝরনার সুর আর পাখির কলতানে ভরা এই জনপদের জীবনযাত্রা চিরকালই আলাদা। আর সেই ভিন্নতার সবচেয়ে বড় প্রতীক হলো—মাচাং ঘর। বাঁশ-খড়ের তৈরি,মাটির ওপর খুঁটির দাঁড়, আর আকাশের কাছাকাছি সেই বসতি। এক সময় পাহাড়ের প্রতিটি গ্রামে চোখ মেললেই দেখা মিলত মাচাং ঘরের। কিন্তু আজ তা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে।
মাচাং ঘরের জন্ম এসেছে পাহাড়ের অভিজ্ঞতা থেকে। ঢালু জমি, বন্য পশুর ভয়, বর্ষার বন্যা আর মাটির ভাঙন—এসবের মোকাবিলা করতেই পাহাড়ি মানুষ খুঁজে নিয়েছিল এই স্থাপত্য। ঘর থাকে ওপরে, নিচে ফাঁকা জায়গা—যেখানে রাখা হয় জ্বালানি কাঠ, গবাদিপশু কিংবা দৈনন্দিন সরঞ্জাম। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এই ঘর শুধু আশ্রয়ই দেয়নি, দিয়েছে নিরাপত্তা, দিয়েছে সংস্কৃতির পরিচয়।
কিন্তু আজ সময় বদলেছে। পাহাড়ের বুকেও ঢুকে পড়েছে ইট-পাথরের আধুনিকতা। টিনের চালা, কংক্রিটের দেয়াল, সরকারি প্রকল্প আর উন্নয়নের মোড়কবন্দি পরিকল্পনা ধীরে ধীরে মুছে দিচ্ছে মাচাং ঘরের অস্তিত্ব। নতুন প্রজন্ম অনেকেই হয়তো আর জানেই না—কেন তাদের দাদারা মাটির ওপরে উঁচু করে ঘর বানাতেন।
তবুও প্রশ্ন থেকে যায়—আমরা কি কেবল আধুনিকতার নামে আমাদের ঐতিহ্য বিসর্জন দেব?
কারণ মাচাং ঘর শুধু একটি বাড়ি নয়। এটি পাহাড়ি জীবনের ইতিহাস, সংগ্রামের দলিল, টেকসই স্থাপত্যের জীবন্ত পাঠশালা। বিশ্ব আজ যেখানে পরিবেশবান্ধব জীবনধারার নতুন নতুন পথ খুঁজছে, সেখানে মাচাং ঘর হতে পারত এক অনন্য উদাহরণ।
এখনই প্রয়োজন এই ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার উদ্যোগ। পর্যটনের সাথে যুক্ত করা যেতে পারে, গবেষণায় স্থান দেওয়া যেতে পারে, কিংবা স্থানীয়দের জন্য সহায়তা প্রকল্প চালু করা যেতে পারে। নাহলে অচিরেই মাচাং ঘর কেবল বইয়ের ছবিতে কিংবা বৃদ্ধদের স্মৃতিচারণেই আটকে যাবে।
মাচাং ঘর পাহাড়ি জীবনের সুর, ঐতিহ্যের স্পন্দন। এই ঘর হারিয়ে যাওয়া মানে শুধু একটি স্থাপত্য হারানো নয়—এটি হবে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের এক অপূরণীয় ক্ষতি।
Leave a Reply