পশ্চিমবঙ্গের শৈল শহর দার্জিলিংয়ে ১৯৫৯ সালের এক গ্রীষ্মের সন্ধ্যা।
অভিজাত হোটেল উইন্ডামেয়ারের সামনে একটা মার্সিডিজ গাড়ি এসে দাঁড়াল। গাড়িটা ছিল সিকিমের যুবরাজ থণ্ডুপের।
হোটেলের লাউঞ্জে বসে নিজের পছন্দের মদের অর্ডার দিলেন যুবরাজ।
তার চোখ পড়ল লাউঞ্জের কোণে বসা এক তরুণীর দিকে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই বন্ধুবান্ধবদের মাধ্যমে তার কাছে খবর চলে এল ওই তরুণীর ব্যাপারে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের এক ছাত্রী, ছুটি কাটাতে ভারতে এসে ওই অভিজাত হোটেলে কিছুদিনের জন্য উঠেছেন।
তরুণীর নাম হোপ কুক।
যুবরাজ থণ্ডুপ দেখা করলেন হোপ কুকের সঙ্গে, আর মুহূর্তেই দুজনে অপরের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন।
যুবরাজের বয়স তখন ৩৬, আর হোপ কুক মাত্র ১৯। কিছুদিন আগেই যুবরাজের স্ত্রী বিয়োগ হয়েছে। তিনটি সন্তানের পিতা থণ্ডুপ বেশ লাজুক ছিলেন। একটু তোতলাতেনও যুবরাজ।
প্রথম দেখা হওয়ার পরে প্রায় দু’বছর দু’জনের মধ্যে আর দেখা হয় নি।
দার্জিলিংয়ে বেড়াতে এসেই সিকিমের যুবরাজের সঙ্গে আলাপ হয় হোপ কুকের
বিয়ের প্রস্তাব দিলেন যুবরাজ
হোপ কুক আবার ভারতে আসেন দু’বছর পরে আর দার্জিলিং-এ এসে তিনি সেই উইন্ডামেয়ার হোটেলেই উঠেছিলেন। আত্মজীবনী ‘টাইম চেঞ্জ’-এ হোপ কুক লিখেছিলেন, “আমি জানি না যুবরাজ কীভাবে জানতে পারলেন যে আমি উইন্ডামেয়ার হোটেলে রয়েছি। আমি একা একাই চা খাচ্ছিলাম, সেই সময়ে তিনি হোটেলের পার্লারে প্রবেশ করলেন।“
“তিনি গুর্খা রেজিমেন্টের একজন সাম্মানিক অফিসার ছিলেন আর একটি সামরিক অনুষ্ঠানে যোগ দিতে গ্যাংটক থেকে এসেছিলেন। সন্ধ্যায় তিনি আমাকে জিমখানা ক্লাবে তার সঙ্গে নাচার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। সে রাতে তিনি খুব ভাল মেজাজে ছিলেন। তিনি আমাকে ফিসফিস করে বললেন একদিন ভিয়েনায় আমরা একসঙ্গে ঘুরবো।“
সেই রাতেই, নাচ করার সময় যুবরাজ হোপ কুককে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি তাকে বিয়ে করার কথা বিবেচনা করবেন কিনা।
হোপ কুকের বয়স তখনও ২১ পেরয় নি। তিনি যুবরাজের প্রস্তাব মেনে নেন। কয়েকদিনের মধ্যেই থণ্ডুপ মিজ কুককে গ্যাংটকে নিয়ে যান। রাজপ্রাসাদ দেখে মিজ কুক তো হতবাক।
হলিউড অভিনেত্রী গ্রেস কেলির সঙ্গে তুলনা
হোপ কুক যখন ১৯৬৩ সালে সিকিমের যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন, তখন আমেরিকান সংবাদ মাধ্যম তার প্রতি ভীষণ সম্মান দেখাতে শুরু করল। তাকে হলিউড অভিনেত্রী গ্রেস কেলির সাথে তুলনা করা হতে থাকল। গ্রেস কেলি মোনাকোর যুবরাজ তৃতীয় রেইনিয়াকে বিয়ে করেছিলেন।
টাইম ম্যাগাজিন ‘সিকিম: আ কুইন রিভিজিটেড’ শিরোনামে ১৯৬৯ সালে একটি প্রতিবেদন ছেপেছিল হোপ কুককে নিয়ে।
ওই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল যে “হোপ কুক সকাল আটটায় ঘুম থেকে ওঠেন। তারপর তিনি বিদেশ থেকে আনা পত্র-পত্রিকা পড়েন। পরের চার ঘণ্টা লাগে বিভিন্ন মানুষকে চিঠি লিখতে, খাবারের মেনু তৈরি করতে আর প্রাসাদের ১৫জন কর্মচারীকে তাদের কাজ বুঝিয়ে দিতে ব্যয় করেন। তার সন্ধ্যাগুলো কাটে এক সেট টেনিস খেলে আর পার্টি করে। রাতের খাবারের আগে স্কচ এবং সোডা ওয়াটার নেওয়ার অভ্যাস ছিল তার।
“তিনি নিজের মার্সিডিজ গাড়িতেই গ্যাংটকের সর্বত্র চলাফেরা করেন, কিন্তু বিদেশ ভ্রমণের সময়ে শুধুমাত্র ইকোনমি ক্লাসেই যেতে পছন্দ করেন,” লিখেছিল টাইম পত্রিকা।
থণ্ডুপ ও হোপে কুকের বিয়ের পর থেকে পশ্চিমা দেশগুলিতে, বিশেষত সামাজিক ও রাজনৈতিক মহলে হাল্কাভাবে, আর সংবাদমাধ্যমে ব্যাপকভাবে, তাদের নিয়ে আলোচনা চলেছিল। মিজ. কুকও এমন আচরণ করতে শুরু করলেন, যেন তিনি স্বাধীন সিকিমের রাণী হতে চলেছেন।
সিকিমের রাজা হিসাবে যুবরাজ থণ্ডুপের অভিষেক, পাশে স্ত্রী হোপ কুক
বিদেশি অতিথিদের সঙ্গে যোগাযোগ বৃদ্ধি
নিউজউইকের ২রা জুলাই, ১৯৭৩ সালের এক প্রতিবেদনে লেখা হয় “হোপ জ্যাকলিন কেনেডির স্টাইলে ফিসফিস করে কথা বলতে শুরু করেছেন। তিনি ‘আমি’-এর বদলে ‘আমরা’ শব্দটা ব্যবহার করছেন এবং আশা করেন যে রাণীদের সঙ্গে যেমন আচরণ করা হয় তার সঙ্গে সেরকমই ব্যবহার করা হবে।“
হোপ কুকের সঙ্গে দেখা করতে চাওয়া বিদেশি অতিথির সংখ্যা বাড়ছিল।
ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত কেনেথ কিটিং এবং যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের সিনেটর চার্লস পার্সি মিজ কুকের সঙ্গে দেখা করার জন্যই গ্যাংটকে এসেছিলেন।
জিবিএস সিধু ভারতের বহির্দেশীয় গুপ্তচর সংস্থা ‘র’-এর বিশেষ সচিব ছিলেন।
তাঁর বই ‘সিকিম – ডন অফ ডেমোক্রেসি’ বইতে মি. সিধু লিখেছেন, “বিদেশিদের সঙ্গে হোপের এই বৈঠকগুলির প্রভাব এতটাই ছিল যে পশ্চিমা দেশগুলিতে ভারতের বিরুদ্ধে এমন অপপ্রচার শুরু হয়েছিল যেন ভারতই সিকিমের স্বাধীনতায় বাধা সৃষ্টি করছে।“
” এখানে উল্লেখ্য, ভারতকে ১৯৫০ সালের চুক্তি বদল করতে বাধ্য করার পিছনে চোগিয়ালের (সিকিমের রাজাদের সাম্মানিক উপাধি) হাত ছিল, কিন্তু তার স্ত্রী হোপ কুক বিষয়টিকে একটি আন্তর্জাতিক ইস্যু করতে সাহায্য করেছিলেন,” লিখেছেন মি. সিধু।
সেই সময়ে দিল্লিতে মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত ইউএস ফরেন সার্ভিস অফিসার উইলিয়াম ব্রাউন লিখেছেন, “৬০-এর দশকে আমাদের সামনে ভারতকে কটূক্তি করার কোনও সুযোগ হাতছাড়া করেননি হোপ কুক।” সূত্র: বিবিসি
Leave a Reply